নিউজ ডেস্ক :: মেরিন ড্রাইভের বাহারছড়া এবিপিএন চেকপোস্টে সেনাবাহিনীর মেজর (অব.) সিনহা মো. রাশেদ খান হত্যা মামলায় টেকনাফ থানার বরখাস্ত ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) প্রদীপ কুমার দাশসহ ১৫ জনকে অভিযুক্ত করে চার্জশিট দিয়েছে র্যাব।
রোববার (১৩ ডিসেম্বর) কক্সবাজারের সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে এই চার্জশিট দাখিল করেন র্যাব-১৫ এর কর্মকর্তা সহকারী পুলিশ সুপার (এএসপি) মো. খায়রুল আলম। চার্জশিটে দণ্ডবিধির ৩০২ ধারায় অভিযোগ আনা হয়। যার সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড। রাষ্ট্রপক্ষের প্রত্যাশা আসামিদের বিরুদ্ধে ৩০২ ধারার অভিযোগ প্রমাণে সক্ষম হবেন।
কক্সবাজার জেলা ও দায়রা জজ আদালতের পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) ফরিদুল ইসলাম বলেন, সিনহা হত্যা মামলায় ওসি প্রদীপসহ ১৫ জনকে অভিযুক্ত করে চার্জশিট দিয়েছে র্যাব। চার্জশিটে আসামিদের বিরুদ্ধে দণ্ডবিধির ৩০২ ধারার অভিযোগ আনা হয়েছে। যার সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড। আমরা আসামিদের বিরুদ্ধে ৩০২ ধারার অভিযোগ প্রমাণ করতে সর্বোচ্চ চেষ্টা করব।
র্যাবের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক লেফটেন্যান্ট কর্নেল আশিক বিল্লাহ জাগো নিউজকে বলেন, ওসি প্রদীপসহ ১৫ আসামি মেজর সিনহাকে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করেছেন। আসামিদের দণ্ডবিধি ৩০২ ধারায় আজ চার্জশিট দেয়া হয়েছে।
এদিকে আজ দুপুরে রাজধানীর কারওয়ান বাজারে র্যাবের মিডিয়া সেন্টারে সংবাদ সম্মেলনে র্যাবের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক লেফটেন্যান্ট কর্নেল আশিক বিল্লাহ বলেন, ওসি প্রদীপের ইয়াবা বাণিজ্যের কথা জেনে যাওয়ায় মেজর (অব.) সিনহা মো. রাশেদ খানকে হত্যা করা হয়। হত্যার পর বাহারছড়া ক্যাম্পের পরিদর্শক লিয়াকত আলীসহ বাকি আসামিদের নিয়ে মাদক উদ্ধারের নাটক সাজান ওসি প্রদীপ। সিনহা হত্যাকাণ্ডের মূল পরিকল্পনাকারী টেকনাফ থানার সাবেক ওসি প্রদীপ। সেখানে ওসি প্রদীপ অস্ত্র ও নির্যাতনের সাম্রাজ্য গড়ে তুলেছিলেন। সরকারি অস্ত্র ব্যবহার করে অনৈতিক কাজ করেছেন তিনি।
তিনি আরও বলেন, ঘটনার সাক্ষী, আলামত, আসামিদের জবানবন্দির মাধ্যমে বস্তুনিষ্ঠভাবে মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা নিশ্চিত হয়েছেন যে, এটি একটি পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড। এ হত্যাকাণ্ডের মূল পরিকল্পনাকারী ওসি প্রদীপ। হত্যাকাণ্ডকে ধামাচাপা দেয়ার জন্য এবং অন্য খাতে প্রবাহিত করার জন্য তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। প্রদীপ কুমার দাসের প্রত্যক্ষ ষড়যন্ত্রে অংশগ্রহণ করেন অন্য আসামি এসআই লিয়াকত আলী, মো. নুরুল আমিন, পুলিশের সোর্স মুহাম্মদ আয়াজ ও মোহাম্মদ নিজামউদ্দিন। আবার লিয়াকত আলীকে সহযোগিতা করেন আরেক পুলিশ সদস্য নন্দদুলাল। পাশাপাশি এপিবিএন’র তিন সদস্যের সহায়তায় এ হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়। পরবর্তীতে ওই ফাঁড়ির আরও পুলিশ সদস্য সিনহার মৃত্যু নিশ্চিত করতে এবং ঘটনা প্রবাহের সঙ্গে জড়িত ছিলেন।
দীর্ঘ চার মাসেরও বেশি সময় পর আলোচিত মামলাটি তদন্ত শেষে প্রতিবেদন জমা দেয়া হলো আজ।
চার্জশিট জমা দেয়ার পর আদালত এলাকায় এএসপি মো. খায়রুল আলম বলেন, ‘সিনহা হত্যা মামলাটি আমরা নানাভাবে তদন্ত করেছি। তদন্তে পাওয়া তথ্যগুলো সাজিয়ে চার্জশিট হিসেবে জমা দেয়া হয়েছে। গণমাধ্যমকে ধন্যবাদ আমাদের সঙ্গে থাকার জন্য।’
তিনি আরও বলেন, ‘হত্যার ঘটনা তদন্তে নেমে র্যাব এ ঘটনায় ১৫ জনের সংশ্লিষ্টতা পেয়েছে। অভিযুক্তদের মধ্যে বরখাস্ত হওয়া ওসি প্রদীপসহ ১৪ জন কারাগারে। সাগর নামের ওসি প্রদীপের এক সহযোগীকে পলাতক দেখানো হয়েছে।’
মামলার তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, মামলায় টেকনাফ থানার সাবেক ওসি প্রদীপ কুমার, বাহারছড়া ক্যাম্পের পরিদর্শক লিয়াকত আলী, এসআই নন্দদুলাল রক্ষিত, টেকনাফ থানার কয়েকজন পুলিশ সদস্য ছাড়াও আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ন-এপিবিএনের তিনজন এবং স্থানীয় তিনজনসহ মোট ১৪ জনকে অভিযুক্তের পর গ্রেফতার করা হয়।
গত ৩ জুলাই ‘জাস্ট গো’ নামের একটি ইউটিউব চ্যানেলে ট্রাভেলস শো ডকুমেন্টারির শুটিংয়ের জন্য তিনজন সহযোগীসহ কক্সবাজারের নীলিমা রিসোর্টে ওঠেন মেজর (অব.) সিনহা। এ খবর পৌঁছায় টেকনাফের তৎকালীন ওসি প্রদীপ কুমারের কাছে। তখন থেকেই ওসি প্রদীপ অধীনস্থ পুলিশ সদস্যদের বলেন, ‘ভিডিও পার্টিকে এখান থেকে সরিয়ে ফেলতে হবে যেকোনো মূল্যে।’ এরপর থেকেই সিনহাকে নজরদারিতে রাখেন পরিদর্শক লিয়াকত ও এসআই নন্দদুলাল রক্ষিত।
৩১ জুলাই সকালে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ‘বৃক্ষরোপণ’ অনুষ্ঠান শেষে ওসি প্রদীপকে জানানো হয়, মেজর সিনহা রাশেদ প্রাইভেটকার নিয়ে টেকনাফের শামলাপুর পাহাড়ে গেছেন। এ সময় সোর্সের মাধ্যমে বাহারছড়া ক্যাম্পের ইনচার্জ ইন্সপেক্টর লিয়াকত আলী সিনহার প্রতি নজর রাখতে থাকেন।
ওইদিন (৩১ জুলাই) রাত ১০টার দিকে কক্সবাজার-টেকনাফ মেরিন ড্রাইভ দিয়ে কক্সবাজারের দিকে আসার পথে বাহারছড়া ইউনিয়নের শামলাপুর চেকপোস্টে তল্লাশির নামে গাড়ি থেকে নামিয়ে মেজর (অব.) সিনহা মো. রাশেদকে গুলি করে হত্যা করা হয়।
ঘটনাটি দেশজুড়ে আলোড়ন সৃষ্টি করে। এ ঘটনায় চট্টগ্রামের অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনার মোহাম্মদ মিজানুর রহমানকে প্রধান করে একটি উচ্চপর্যায়ের তদন্ত কমিটি গঠন করে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জন ও নিরাপত্তা বিভাগ। একইভাবে তদন্তের স্বার্থে টেকনাফের বাহারছড়া তদন্ত কেন্দ্রের ইনচার্জ লিয়াকত আলীসহ ১৬ পুলিশ সদস্যকে প্রত্যাহার করা হয়।
এদিকে, ৫ আগস্ট সিনহার বোন শারমিন শাহরিয়ার ফেরদৌস বাদী হয়ে টেকনাফ থানার সাবেক ওসি প্রদীপ কুমার দাসসহ ৯ জনকে আসামি করে হত্যা মামলা করেন। মামলায় প্রধান আসামি করা হয় বাহারছড়া পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ পরিদর্শক লিয়াকত আলীকে, যিনি সিনহাকে গুলি করেছিলেন। টেকনাফ থানার ওসি (বরখাস্ত) প্রদীপ কুমার দাসকে করা হয়েছে দুই নম্বর আসামি।
পাঠকের মতামত: